১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্যামসাং, সময়ের সাথে সাথে তার ব্যাপ্তিকে নিয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেবল বিশ্বের বৃহত্তম মোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বলেই নয়, গুণগত মান ও বৈচিত্রের দিক থেকে তাদের পণ্যসমূহও অনন্য। এ পর্যন্ত মোটামুটি সবাই-ই আমরা অবগত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সুবিশাল পরিধি এবং কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে আমাদের ধারণা কমই। জেনে অবাক হতে পারেন, বুর্জ খলিফার মতো আকাশচুম্বী ভবনের নির্মাণশৈলীতেও ভূমিকা ছিল স্যামসাং-এর।
স্যামসাং সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ বিষয়ই রয়ে গেছে আমাদের জানা-পরিধির বাইরে। প্রতিষ্ঠানটির সেই সকল অজানা তথ্য নিয়েই আজকের আয়োজন।
১ম সিডিএমএ ফোনঃ
১৯৯৬ সালে স্যামসাং সিডিএমএ প্রযুক্তিতে SCH-100 নামের নতুন একটি ফোন বাজারে নিয়ে আসে। তখনকার দিনে এই প্রযুক্তি ছিল একদমই নতুন একটি ধারণা। বর্তমানের জিএসএম নেটওয়ার্কের তুলনায় তখনকার এই প্রযুক্তিতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ফোনটি বাজারে বেশ ভালো সাড়া ফেলে দেয়।
সিডিএমএ প্রযুক্তির ফোন SCH-100; Image Source: Samsung Tomorrow
১ম ঘড়ি ফোনঃ
১৯৯৯ সালে স্যামসাং হাতে পরিধানযোগ্য ঘড়ি-ফোনের ধারণা নিয়ে সবার সামনে হাজির হয়। SPH-WP10 মডেলের এই ফোনটি দেখতে ছিল অনেকটা ঘড়ির মতোই, আবার এতে বেল্ট থাকার কারণে হাতে পরিধান করা যেতো। এক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি সবার আগে একটি নতুন ধারণা নিয়ে হাজির হয়েছিল। হাতে পরিধানযোগ্য এই ফোন দিয়ে একটানা ৯০ মিনিট কল এবং টেক্সটিং করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নতুন এই ঘড়ি ফোন ধারণাটি তখন বাজারে জনপ্রিয় হয়নি।
হাতে পরিধানযোগ্য ঘড়ি ফোন; Image Source: Samsung
অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএসের আগেই স্মার্টফোনের ধারণাঃ
স্যামসাং যদিও সবার আগে পরিপূর্ণ স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসতে পারেনি, কিন্তু ধারণার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বেশ এগিয়ে ছিল। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্ট অপারেটরের জন্য SPH-i300 নামের একটি পিডিএ ফোন বাজারে নিয়ে আসে। পাম ওএস চালিত এই ফোনে আধুনিক স্মার্টফোন ধারণার অনেক বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল।
১ম পিডিএ ফোন; Image Source: Samsung
বিক্রির দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটির সেরা ফোনঃ
স্যামসাং ই১১১০ নামের ফিচার ফোনটি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সবথেকে বেশি বিক্রিত মোবাইল ফোন। ২০০৯ সালে বাজারে আসা এই ফিচার ফোনটি পরবর্তী ৩ বছর পর্যন্ত উৎপাদনে ছিল। এক পরিসংখ্যান অনুসারে, এ সময়ে স্যামসাং প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউনিট ই১১১০ বাজারে বিক্রি করেছে।
স্যামসাং ই১১১০; Image Source: Fony.sk
ফিচার ফোনের এই মডেলটি পৃথিবীতে মোবাইল ফোনের বিক্রির ইতিহাসে ৮ম অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে।
বিক্রিতে সেরা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনঃ
প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে বিক্রির দিক থেকে সেরা স্মার্টফোনটি হচ্ছে গ্যালাক্সি এস৪। প্রায় ৮০ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রির রেকর্ড নিয়ে সর্বাধিক বিক্রিত মোবাইল ফোনের তালিকায় স্মার্টফোনটি ১৪তম অবস্থানে রয়েছে।
গ্যালাক্সি এস৪; Image Source: Android Authority
মজার তথ্যটি হচ্ছে, গ্যালাক্সি এস৪ পৃথিবীতে বিক্রির রেকর্ডের দিক থেকে এক নম্বর অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক স্মার্টফোন। স্মার্টফোন বিক্রির তালিকায় এই ফোনের আগে দুটি অন্য মডেলের স্মার্টফোন এগিয়ে থাকলেও সেগুলো আইওএস এবং সিম্বিয়ান ভিত্তিক।
অ্যান্ড্রয়েড কেনার সুযোগ হাতছাড়াঃ
আপনি জানেন কি, স্যামসাং কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডকে একদম শুরুর দিকে কিনে নেওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছে!
অ্যান্ড্রয়েড প্রজেক্টের একদম শুরুর দিকে, অর্থাৎ তত্ত্ব ও ধারণার আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্যস্যামসাং-কে প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু স্যামসাং তখন এই প্রজেক্টটিকে উচ্চাভিলাষী অভিহিত করে ‘না’ করে দেয়। আর এই সুযোগটিই লুফে নেয় গুগল। তারা প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে পুরো প্রজেক্টটি নিজেদের করে নেয়। আর ঠিক এভাবেই স্যামসাং অ্যান্ড্রয়েড কিনে নেওয়ার সহজ সুযোগটিকে হাতছাড়া করে।
গুগল সদরদপ্তর; Image Source: Android Authority
প্রহরী রোবটঃ
এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা নিশ্চয়ই। স্যামসাং কিন্তু কোরিয়া সীমান্তে বসানো একটি প্রহরী রোবটের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও বটে। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া অংশে অনুপ্রবেশ রোধের লক্ষ্যে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে, এসজিআর-এ১ নামের একটি প্রহরী সামরিক রোবট বসানো আছে। এই রোবট মানুষের উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, নিরাপত্তা প্রহরার পাশাপাশি এই রোবট বেশ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মেশিন-গানের ভূমিকাও পালন করছে।
২০০৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে এই রোবটিক প্রতিরক্ষার ঘোষণা আসলেও, পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। প্রায় দুই লক্ষ মার্কিন ডলার খরচে তৈরি এই রোবট আইআর ক্যামেরার সাহায্যে লক্ষ্যবস্তু নির্ণয়ে সক্ষম। মেশিন-গানের পাশাপাশি প্রয়োজনে রোবটটির গ্রেনেড ছোঁড়ার সক্ষমতাও আছে।
সুবিশাল কলেবর ও কর্মী-পরিধিঃ
আগেই বলা হয়েছে, শুধুমাত্র একটি ইলেকট্রনিক্স কিংবা স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকের পরিচয়ের বাইরেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মযজ্ঞ আরও অনেক বিস্তৃত। স্যামসাং গ্রুপ ১৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং প্রায় ৫৯টি তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত। এই কোম্পানিগুলোর সবগুলোই আবার দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁজি-বাজারে নিবন্ধিত। নির্মাণশিল্প থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক পরিষেবা, জাহাজ নির্মাণ, এমনটি ওষুধ শিল্পেও স্যামসাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজ করছে। পৃথিবীর ৮০টি দেশে প্রায় ৫ লক্ষ কর্মী মিলে সামাল দিচ্ছে এই মহা-কর্মযজ্ঞ।
সিউলে স্যামসাং-এর প্রধান কার্যালয়; Image Source: Travel Channel
স্যামসাং ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিঃ
শুধু নিজেদের মুনাফাই নয়, বরং দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক জিডিপিতেও নিরন্তর অবদান রেখে চলেছে স্যামসাং। ২০১৭ সালের সিএনএন-এর এক রিপোর্ট অনুসারে, কোরিয়ার সামগ্রিক জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ আসে শুধুমাত্র স্যামসাং থেকে। কোরিয়ার পুঁজি-বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ লেনদেন স্যামসাং এবং এর সম্পূরক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স।
স্যামসাং ও তার কিছু সম্পূরক প্রতিষ্ঠান; Image Source: Android Authority
৯৫ সালের অভিনব সংশোধনীঃ
গুণগত পরিবর্তনের এক জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে স্যামসাং বাজারে ততটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে প্রধান লি কুন হি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। ফোন, টেলিভিশন, ফ্যাক্স মেশিনসহ কয়েকটি স্যামসাং পণ্যের বিরুদ্ধে আসতে থাকা বেশ কিছু মারাত্মক অভিযোগই ডেকে এনেছিল এই দুর্গতি।
প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান লি কুন হি; Image Source: Wikipedia
লি তখন বুদ্ধিদীপ্ত একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রায় দু’হাজার কর্মীর সামনে ত্রুটিযুক্ত এসব পণ্য বিনষ্ট করার এক অভিনব আয়োজন করেন তিনি। একদিনে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্যসামগ্রী ধ্বংস করে ফেলা হয়। আর ঠিক এই কাজটির ফলেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মধ্যে এক তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয়।
১৯৯৫ সালের এই ঘটনা স্যামসাং-কে আমূল বদলে দেয়। নতুন ব্যবস্থাপনা আর সত্যিকারের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের মাধ্যমে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির আজকের গৌরবময় জয়যাত্রার অনেকটা কৃতিত্ব লি আর তার বোর্ডের, তাদের সেই 'ড্রপটেস্ট'-এর।